সোনালী সোপানে আমাদের ক্রিকেট
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
শীতের
এই শুরুতে ফ্লাড লাইটের আলোয় মিরপুর স্টেডিয়ামকে একটা মায়াবী রহস্যপুরী
বলেই মনে হয়। এই মায়াবী আলোয় বাংলাদেশ দেখেছে ক্রিকেটারদের অসম্মানজনক
পরাজয়ে শোকার্ত মুখ, দেখেছে কাছে গিয়ে তরী ডোবার কান্না। আর বৃহস্পতিবার
সেই মায়াবী আলোতেই পুরো বিশ্ব দেখল বাংলাদেশের উল্লাস। আরো একবার সিরিজ
জয়ে আনন্দে ভাসল বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা। এই উল্লাসকে আর দশটা দেশের একটা ম্যাচ বা সিরিজ জয়ের উল্লাসের সঙ্গে তুলনা করার ভুল কোনোক্রমেই করা যাবে না। বৃহস্পতিবারের এই উল্লাস, পতাকা হাতে খেলোয়াড়দের এই ল্যাপ অব অনার আসলে একটা ঘোষণা- বাংলাদেশ এখন আর শুধু লড়াকু দেশ নয়, বাংলাদেশ এখন বিজয়ীদের দেশ। বাংলাদেশ এখন জিততে জিততে যেন হারতেই ভুলে গেছে!
হ্যা, একসময় যে বাংলাদেশ ক্রিকেট মাঠে নামত 'হারার জন্য', একসময় যে বাংলাদেশের খেলা মানেই সবাই আরেকটি পরাজয়ের জন্য অপেক্ষায় থাকত; সেই বাংলাদেশের কাছে এখন পরাজয়টাও বরং অপরিচিত শব্দ হয়ে উঠছে। এগুলো কথার কথা নয়। শুধু পরিসংখ্যানেই চোখ বুলালে বুঝতে পারবেন, জয় ব্যাপারটা এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য কতোটা পরিচিত একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
অল্প কিছু পরিসংখ্যান দেয়া যাক। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ওয়ানডে খেলেছে ২৭৫টি; এর মধ্যে ৭৯টি জয় ও ১৯৩টি পরাজয়। এই পরিসংখ্যান দেখলে মোটেও সম্মানজনক মনে হবে না। এবার একটু ভেঙে দেখুন। ২০০৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ১০৫টি ওয়ানডে খেলে জয় পেয়েছে মাত্র ৬টি ম্যাচে। অথচ এরপর গত পরশু পর্যন্ত বাংলাদেশ যে ১৭২টি ম্যাচ খেলেছে, তার মধ্যে ৭৩টিতেই জয় পেয়েছে তারা! আরো একটু দেখুন- বাংলাদেশ নিজের সর্বশেষ ১৬টি ওয়ানডে ম্যাচে ৯টিতেই জয় পেয়েছে; এই সময়ে জয়ের হার শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি। আর এই সময়ে কাদের হারিয়েছি আমরা? ভারতকে একবার, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডকে দু বার এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিনবার!
এই পরিসংখ্যান কী অন্তত এটুকু সাক্ষ্য দেয় না যে- বাংলাদেশ এখন আসলেই ওয়ানডে ক্রিকেটের এক পরাশক্তি দল!
কীভাবে বাংলাদেশ এই
জায়গায় চলে এলো?
বাংলাদেশকে ২০০০ সালে যখন টেস্ট স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল, তখন কার্যত আমাদের ঝুলিতে ক্রিকেটীয় সম্পদ তেমন কিছু ছিল না। আইসিসি থেকে একটা কথা বলা হয়েছিল- মূলত অবকাঠামো, সংগঠকদের আগ্রহ এবং প্রধানত বিশাল উন্মাতাল সমর্থকদের দিকে চেয়েই বাংলাদেশকে এই পদে ভূষিত করা হল।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরু থেকেই খেলাটির সবচেয়ে বড় সম্পদ সমর্থক-দর্শকরা ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের আগ পর্যন্ত হয়তো ক্রিকেটের চেয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াপাগল মানুষদের বুকে ফুটবলটাই বেশি জায়গা জুড়ে ছিল; কিন্তু ক্রিকেটও লুকানো ছিল কোথাও। না হলে এক আইসিসি ট্রফি জয়ে দেশে কোটি মানুষ কী করে রাস্তায় নেমে আসে!
১৯৯৭ সালে সেই আইসিসি ট্রফি জয়কে বলা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেট সাফল্যের যাত্রা শুরুর ক্ষণ। এর আগে সেই বৃটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশে ক্রিকেটের চর্চা ছিল। কিন্তু প্রথমে ব্রিটেন, পরে পাকিস্তানের অধীন থাকায় এখানে ক্রিকেটাররা সেভাবে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাননি। পাকিস্তান আমলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় দলে এই বাংলার অনেক খেলোয়াড়ই ডাক পাননি। স্বাধীনতার আগের বঞ্চনা এবং অনেক ক্রিকেটারের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ; দুই মিলিয়ে নতুন জন্ম নেয়া দেশটার প্রতি ক্রিকেটারদের ভালোবাসা শুরু থেকেই অসীম।
দেশ স্বাধীনের পর একটু সবকিছু শান্ত হয়ে গেলে ব্যাপকভাবে শুরু হয় দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট। তারই প্রতিফলন পড়তে থাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে খাপ খাইয়ে নেয়ায় সহযোগিতা করতে হায়দারাবাদ ব্লুস, এমসিসির মতো দল বাংলাদেশ সফর শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কার মোরাতুয়াতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলে ফেলে নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
এরপর বার তিনেকের কঠোর চেষ্টার পর ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়। সেই বিশ্বকাপেই পাকিস্তানকে হারিয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দাবি জোরদার করে। পরের বছর সে দাবিও পূরণ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৯৯ থেকে ২০০৪; এই পাঁচ বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট একেবারে সামনে হাঁটতে পারেনি। এই সময়ে বাংলাদেশ আর একটিও ওয়ানডে ম্যাচ জিততে পারেনি। অবশেষে ২০০৪ সালের ১০ মার্চ হারারেতে সোনালী প্রজন্মের জিম্বাবুয়েকে হারায় বাংলাদেশ। আর পরের বছর থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের সত্যিকারের জয়ের পথে চলা; যারই ফল হিসেবে এখন দেখছেন এই টানা জয়ের রথ ছোটানো, নিউজিল্যান্ডকে একটার পর একটা সিরিজে কুপোকাত করা, দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা কিংবা শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তাদের বিপক্ষে ড্র করে আসা।
এই সাফল্যের পথে আসার মুকুটে একটা বড় পালক ছিল ২০১১ সালের বিশ্বকাপের সফল আয়োজক হওয়া।
সেবার বাংলাদেশে যখন বিশ্বকাপের খেলা হচ্ছিল, তখন আরেকবার এই দর্শক-সমর্থকদের দেখে বিস্মিত, চমত্কৃত হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্ব। পৃথিবীর সব বড় বড় সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের সমর্থকদের নিয়ে লেখা হচ্ছিল। সেই সময় একদিন প্রেসবক্সে বসে প্রয়াত কিংবদন্তী সাংবাদিক পিটার রোবাক বলছিলেন, 'বাংলাদেশের অবশ্যই এক নম্বর ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হওয়া উচিত।'
সবাই অবাক হয়েছিলেন রোবাকের কথা শুনে। সবাই প্রশ্ন করেছিলেন- কেন?
রোবাক গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, 'যে দেশের কোটি কোটি মানুষ ক্রিকেটের জন্য এভাবে রাস্তায় নামতে পারে, তারা এক নম্বর হবে না তো, কারা হবে!' সত্যিই তো। আমাদের এক নম্বর হতে আর কী চাই!