হরতাল প্রত্যাহার করে সংলাপে আসুন-খালেদার প্রতি হাসিনা
জেলহত্যা দিবসে সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভা
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যথাসময়ে ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। হরতাল না করার ঘোষণা দিয়ে সংলাপে আসার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনার দরজা খোলা আছে। তবে সর্বাগ্রে হরতাল প্রত্যাহার করতে হবে। জাতির কাছে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ওয়াদা করতে হবে আর হরতাল দিয়ে মানুষ খুন ও দেশের সম্পদ নষ্ট করবেন না। যথাসময়েই আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। ইনশাল্লাহ দেশের জনগণ উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশসেবার সুযোগ দেবে।
হরতালের নামে কেউ যাতে জানমালের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য প্রত্যেক এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির মাধ্যমে সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য স্বাধীনতা ও মুুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিরোধীদলীয় নেত্রী যতই চেষ্টা করুন না কেন, তাদের রক্ষা করতে পারবেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই এবং রায়ও কার্যকর হবে। তাই আমি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে অনুরোধ করব ছোট ছোট শিশুদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। ছোট শিশুদের শিক্ষা জীবন ধ্বংস ও কমল মন ভেঙ্গে দেবেন না। হরতাল প্রত্যাহার করে ২১ লাখ ছাত্রছাত্রীকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিন। যানবাহনে, বাড়িতে আগুন দিয়ে, মানুষ খুন করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে আর অসম্মান না করতেও তিনি বিরোধী দলের নেতার প্রতি আহ্বান জানান।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, সংলাপে সাড়া না দিয়ে আপনি (খালেদা জিয়া) মানুষ মারছেন। আবার হরতাল দিয়েছেন! আর কত মায়ের বুক আপনি খালি করতে চান? আর কত মানুষের জীবন নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলবেন। এর আগে হরতাল দিয়ে যে ২০টি মানুষের প্রাণ আপনি কেড়ে নিয়েছেন, এত মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এভাবে দেশবিরোধী ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। দেশকে আর ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না।
শোকাবহ-রক্তক্ষরা ৩ নবেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে রবিবার বিকেলে ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল এই জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আগের ৬০ ঘণ্টার হরতাল করে আপনি (খালেদা জিয়া) কী অর্জন করেছেন? হরতালের নামে ২০ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছেন, সরকারের উন্নয়নে বাধা দিয়েছেন। ক্ষমতায় থাকতে তো দেশের কোন উন্নয়ন করেননি, করেছেন নিজেদের উন্নয়ন। নিজে চুরি করে কালো টাকা সাদা করেছেন, এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। দুই পুত্রকে দিয়ে হাওয়া ভবনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। সেই অর্থ আমরা বিদেশ থেকে ফেরত এনেছি, আগামীতে আরও আনা হবে। নিজে উন্নয়ন করতে পারেননি বলে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবেন না।
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে এ সমাবেশ আয়োজন করা হলেও লাখো মানুষের সমাগম ঘটিয়ে সমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রবিবার রাজধানীতে প্রাক-নির্বাচনী বড় ধরনের শোডাউন করল শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে সমাবেশে আসা হাজার হাজার মানুষের হাতে দলীয় প্রতীক আর নৌকা মার্কার সেøাগানে প্রকম্পিত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভাটি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী জনসভাতেই রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সকল নেতার বক্তব্যেই ছিল আগামী নির্বাচন, সরকারের উন্নয়ন ও বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা।
বিশাল এ জনসভা শুধু জেলহত্যা দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে বিশাল শোডাউন দেয়ার পরিকল্পনা অন্তর্নিহীত ছিল। হয়েছেও তাই। জনসভা উপলক্ষে দুপুর থেকেই জনতার ঢল নামে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। প্রধানমন্ত্রী যখন ৪টা ৩৫ মিনিটে বক্তব্য দেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেন তখনও মিছিল নিয়ে হাজার হাজার জনতা উদ্যানে প্রবেশ করে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ ছিল রাজপথে। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ছবি ও তাদের নামে সেøাগান ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া সবার মুখে মুখে ছিল নির্বাচনী সেøাগান। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা-নৌকা সেøাগানে মুখরিত হয় গোটা জনসভাস্থল। এক পর্যায়ে টিএসসি, শাহবাগের মোড়, দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে যায় জনসভার সীমানা।
দুপুর ২টায় জনসভার শুরুর সময় নির্ধারণ করা হলেও বেলা ১২টার পর থেকেই ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে খ- খ- মিছিল নিয়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে লোক-সমাগম শুরু হয়। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল মঞ্চ থেকে সকাল ১০টা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সাড়া জাগানিয়া গান ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো হয়। বেলা একটার পর থেকেই সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার স্রোত নামে। হাজার হাজার মিছিলে আসা মানুষের নৌকা মার্কার প্রকম্পিত সেøাগান এবং মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিশাল বিশাল শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর ১৫টি আসন থেকে এবং সাভারসহ আশপাশের জেলা থেকেও নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে জনসভায় যোগ দিতে দেখা যায়।
দুপুর আড়াইটায় জনসভা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিকেল সাড়ে চারটায় বক্তব্যে দিতে শুরু করেন তখনও বিভিন্ন এলাকা থেকে অগণিত মিছিলের স্রোত ছিল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানমুখী। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল চত্বর ছাড়াও মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ ঘুরে টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো এলাকা ছিল লোকেলোকারণ্যে। তবে ডিএমপির নিষেধাজ্ঞার কারণে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে থেকে শাহবাগ পর্যন্ত কোন মাইক না থাকায় হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে শুনতে না পারে ক্ষুব্ধ ও হতাশা ব্যক্ত করেন।
ঘুরে দেখা দেখে, বিপুল পরিমাণ উৎসাহ নিয়ে সমাবেশে আসলেও মাইকের মাধ্যমে বক্তব্যে শুনতে না পারায় অনেক মানুষকেই চলে যেতেও দেখা গেছে। আয়োজকদের দাবি, ডিএমপির নিষেধাজ্ঞার কারণে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের চতুর্দিকের সকল রাস্তায় মাইক লাগানো হলেও পরে তা খুলে নেয়া হয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। তবে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তীব্র জনস্রোতের কারণে এই পুরো এলাকাই কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ফলে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। সন্ধ্যার পরও যানজটে আটকা থেকে বিপুল মানুষকে দুর্ভোগও পোহাতে হয়।
সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশাল এ জনসভায় আরও বক্তব্যে রাখেন উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, নগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আহমদ হোসেন, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, যুবলীগের হারুনুর রশিদ, শ্রমিক লীগের শুক্কুর মাহমুদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্লা মোঃ আবু কাউছার, কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা, যুব মহিলা লীগের নাজমা আখতার এমপি, ছাত্রলীগের এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ প্রমুখ বক্তব্যে রাখেন। সমাবেশ পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা জড়িত ছিলেন বলেই ঘটনার দিন আত্মগোপনে গিয়েছিলেন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি সিএনএন অনলাইনে একটি রিপোর্টের কথা তুলে ধরে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৫২ দিনের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। ওই বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সামরিক অফিসারসহ প্রায় ৭৩ জন প্রাণ হারান। ওই ৫৭ সামরিক অফিসারের মধ্যে ৩৩ জনই ছিল আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান।
তিনি বলেন, এই বর্বরোচিত ঘটনার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতারা যে জড়িত ছিল, বিপুল অর্থায়ন করেছে তা সিএনএনের প্রকাশিত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে। উনার নেতারা জড়িত ছিলেন বলেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার কিছু আগেই তিনি (খালেদা জিয়া) ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। এখন বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় খুনীদের পক্ষে যেসব আইনজীবী আইন লড়াই করছেন, তাদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের লোক। আসলে খুনীদের লালন-পালন, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতিই হচ্ছে তাঁর (খালেদা জিয়া) রাজনীতি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল ক্ষমতায় আসলে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। আমরা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছি, অনেকগুলোর রায়ও ইতোমধ্যে পেয়েছি। কিন্তু এসব কাজ পছন্দ নয় আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় তিনি হরতালের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারছেন, যানবাহনে আগুন দিচ্ছেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন। উল্টো এই সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, উনি ক্ষমতায় গেলে নাকি সব যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেবেন। স্বাধীন দেশে এর থেকে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?
তিনি বলেন, খুনী, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করাই বিরোধী দলের নেতার চরিত্র। ক্ষমতায় থাকতে তিনি খুনী, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন। ২১ আগস্ট আমাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তারা হত্যার বিচার না করে উল্টো আলামত পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছিল, জজ মিয়ার নাটক সাজিয়েছিল। আজ প্রমাণ হয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তাঁর (খালেদা জিয়া) মন্ত্রিসভার সদস্য ও ছেলে তারেক রহমান জড়িত ছিল।
বিরোধী দলের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রীকে আগেরবার আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলাম। জবাবে উনি ৪ মে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন এই সময়ের মধ্যে তিনি সরকারকে উৎখাত করবেন, আমি নাকি পালানোরও পথ খুঁজে পাব না। কৈ আমি তো এখনও বহাল তৈবিয়তেই আছি। আলোচনায় না এসে উনি জামায়াত ও হেফাজতকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দিলেন, শ’ শ’ কোরান শরীফ পুড়িয়ে দিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা ইসলাম ধর্মের হেফাজতের নামে কোরান শরীফ পুড়িয়ে দেয় তারা কী ভাবে ইসলামকে হেফাজত করতে পারে? আর এদের নেত্রী হচ্ছেন খালেদা জিয়া। তাদের ধোঁকাবাজি ও ভাওতাবাজির রাজনীতি দেশবাসী ভাল করেই বুঝে গেছে।
দুই নেত্রীর মধ্যে ফোনালাপের প্রসঙ্গে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবসময়ই শান্তিতে বিশ্বাস করি। আর এ কারণে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ফোন করে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালাম। তিনি বলেন, আমি জানি উনি (খালেদা জিয়া) সকালে উঠতে পারে না, সে কারণেই দুপুরে রেড টেলিফোনে কয়েকবার ফোন করলাম। কিন্তু উনি ধরলেন না। পরে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির এক নেতা জানালেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী রাত ৯টার আগে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচে আসতে পারবেন না। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে করে বলেন, যিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী, আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আগামীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন- তাঁর একটি ফোন ধরতে দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে, উনি ক্ষমতায় আসলে দেশের জন্য কী করবেন?
তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার পর ফোন করে আমি তাঁকে হরতাল প্রত্যাখ্যান করে গণভবনে এসে আলোচনা করার আমন্ত্রণ জানালাম। উনি আমার কথা রাখলেন না। হরতাল করে ২০ জন মানুষকে হত্যা করলেন। এই ২০ মানুষের হত্যার দায়-দায়িত্বও তো তাঁকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, দেশের ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন থাকার পরও আমি দেশ ও জাতির স্বার্থে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানালাম আসুন সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচন করি, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। আপনি কোন কোন মন্ত্রিসভা চান, আসুন আলোচনা করে ঠিক করি। শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে ফোনালামে আমাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে। তার পরও আমার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উনি হরতাল করে মানুষের জীবনহানী ঘটালেন? আর কত রক্ত ও মায়ের বুক তিনি খালি করতে চান?
আবারও ৬০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বানের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাল (সোমবার) ২১ লাখ ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। উনি হরতাল দিয়ে এত কমলমতি ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার পথ বন্ধ করে দিলেন। নিজে এসএসসি পাস করতে পারেননি, সরকারী কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে দুই ছেলেকে উনি কী শিক্ষা দিয়েছেন? পড়াশুনা নয় উনি ছেলেদের মানুষ হত্যা, গ্রেনেড মারা, হাওয়া ভবন খুলে ব্যবসার কমিশন খাওয়া আর বিদেশে অর্থ পাচার করা শিখিয়েছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি (খালেদা জিয়া) ওয়ান ইলেভেনের কথা ভুলে গেছেন। তাঁর কারণেই তো ১/১১’র সৃষ্টি। উনি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ছাড়াও ৯ জনকে ডিঙ্গিয়ে মঈন উ আহমদকে সেনাপ্রধান এবং জাতিসংঘ থেকে ডেকে এনে ফখরুদ্দিন আহমদকে গবর্নর করেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তাঁর এত প্রিয় লোক থাকতেও তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে, দুই ছেলেকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। সেই একই জিনিস (তত্ত্বাবধায়ক) তিনি চাচ্ছেন কার স্বার্থে? আবারও তত্ত্বাবধায়ক আসলে উনাকে যে জেলে যেতে হবে না তার গ্যারান্ট্রি কোথায়? তিনি বলেন, আর যাতে কেউ অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে সংবিধান সংশোধন করে তা আমরা নিশ্চিত করেছি।
আগামীতে হরতালের নামে কেউ জানমালের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের সকল মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব কমিটির মাধ্যমে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে। যথাসময়েই আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলব। ইনশাল্লাহ দেশের মানুষ আবারও নৌকায় মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের দেশসেবার সুযোগ দেবে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বসভায় উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব।
জেলহত্যা দিবসে সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভা
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যথাসময়ে ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। হরতাল না করার ঘোষণা দিয়ে সংলাপে আসার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনার দরজা খোলা আছে। তবে সর্বাগ্রে হরতাল প্রত্যাহার করতে হবে। জাতির কাছে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ওয়াদা করতে হবে আর হরতাল দিয়ে মানুষ খুন ও দেশের সম্পদ নষ্ট করবেন না। যথাসময়েই আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। ইনশাল্লাহ দেশের জনগণ উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে দেশসেবার সুযোগ দেবে।
হরতালের নামে কেউ যাতে জানমালের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য প্রত্যেক এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির মাধ্যমে সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য স্বাধীনতা ও মুুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিরোধীদলীয় নেত্রী যতই চেষ্টা করুন না কেন, তাদের রক্ষা করতে পারবেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই এবং রায়ও কার্যকর হবে। তাই আমি বিরোধীদলীয় নেত্রীকে অনুরোধ করব ছোট ছোট শিশুদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। ছোট শিশুদের শিক্ষা জীবন ধ্বংস ও কমল মন ভেঙ্গে দেবেন না। হরতাল প্রত্যাহার করে ২১ লাখ ছাত্রছাত্রীকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিন। যানবাহনে, বাড়িতে আগুন দিয়ে, মানুষ খুন করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে আর অসম্মান না করতেও তিনি বিরোধী দলের নেতার প্রতি আহ্বান জানান।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, সংলাপে সাড়া না দিয়ে আপনি (খালেদা জিয়া) মানুষ মারছেন। আবার হরতাল দিয়েছেন! আর কত মায়ের বুক আপনি খালি করতে চান? আর কত মানুষের জীবন নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলবেন। এর আগে হরতাল দিয়ে যে ২০টি মানুষের প্রাণ আপনি কেড়ে নিয়েছেন, এত মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এভাবে দেশবিরোধী ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। দেশকে আর ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না।
শোকাবহ-রক্তক্ষরা ৩ নবেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে রবিবার বিকেলে ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল এই জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আগের ৬০ ঘণ্টার হরতাল করে আপনি (খালেদা জিয়া) কী অর্জন করেছেন? হরতালের নামে ২০ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছেন, সরকারের উন্নয়নে বাধা দিয়েছেন। ক্ষমতায় থাকতে তো দেশের কোন উন্নয়ন করেননি, করেছেন নিজেদের উন্নয়ন। নিজে চুরি করে কালো টাকা সাদা করেছেন, এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। দুই পুত্রকে দিয়ে হাওয়া ভবনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। সেই অর্থ আমরা বিদেশ থেকে ফেরত এনেছি, আগামীতে আরও আনা হবে। নিজে উন্নয়ন করতে পারেননি বলে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবেন না।
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে এ সমাবেশ আয়োজন করা হলেও লাখো মানুষের সমাগম ঘটিয়ে সমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রবিবার রাজধানীতে প্রাক-নির্বাচনী বড় ধরনের শোডাউন করল শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে সমাবেশে আসা হাজার হাজার মানুষের হাতে দলীয় প্রতীক আর নৌকা মার্কার সেøাগানে প্রকম্পিত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভাটি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী জনসভাতেই রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সকল নেতার বক্তব্যেই ছিল আগামী নির্বাচন, সরকারের উন্নয়ন ও বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা।
বিশাল এ জনসভা শুধু জেলহত্যা দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে বিশাল শোডাউন দেয়ার পরিকল্পনা অন্তর্নিহীত ছিল। হয়েছেও তাই। জনসভা উপলক্ষে দুপুর থেকেই জনতার ঢল নামে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। প্রধানমন্ত্রী যখন ৪টা ৩৫ মিনিটে বক্তব্য দেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেন তখনও মিছিল নিয়ে হাজার হাজার জনতা উদ্যানে প্রবেশ করে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ ছিল রাজপথে। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ছবি ও তাদের নামে সেøাগান ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া সবার মুখে মুখে ছিল নির্বাচনী সেøাগান। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা-নৌকা সেøাগানে মুখরিত হয় গোটা জনসভাস্থল। এক পর্যায়ে টিএসসি, শাহবাগের মোড়, দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে যায় জনসভার সীমানা।
দুপুর ২টায় জনসভার শুরুর সময় নির্ধারণ করা হলেও বেলা ১২টার পর থেকেই ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে খ- খ- মিছিল নিয়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে লোক-সমাগম শুরু হয়। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল মঞ্চ থেকে সকাল ১০টা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সাড়া জাগানিয়া গান ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো হয়। বেলা একটার পর থেকেই সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার স্রোত নামে। হাজার হাজার মিছিলে আসা মানুষের নৌকা মার্কার প্রকম্পিত সেøাগান এবং মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিশাল বিশাল শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর ১৫টি আসন থেকে এবং সাভারসহ আশপাশের জেলা থেকেও নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে জনসভায় যোগ দিতে দেখা যায়।
দুপুর আড়াইটায় জনসভা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিকেল সাড়ে চারটায় বক্তব্যে দিতে শুরু করেন তখনও বিভিন্ন এলাকা থেকে অগণিত মিছিলের স্রোত ছিল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানমুখী। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল চত্বর ছাড়াও মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ ঘুরে টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো এলাকা ছিল লোকেলোকারণ্যে। তবে ডিএমপির নিষেধাজ্ঞার কারণে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে থেকে শাহবাগ পর্যন্ত কোন মাইক না থাকায় হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে শুনতে না পারে ক্ষুব্ধ ও হতাশা ব্যক্ত করেন।
ঘুরে দেখা দেখে, বিপুল পরিমাণ উৎসাহ নিয়ে সমাবেশে আসলেও মাইকের মাধ্যমে বক্তব্যে শুনতে না পারায় অনেক মানুষকেই চলে যেতেও দেখা গেছে। আয়োজকদের দাবি, ডিএমপির নিষেধাজ্ঞার কারণে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের চতুর্দিকের সকল রাস্তায় মাইক লাগানো হলেও পরে তা খুলে নেয়া হয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে। তবে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তীব্র জনস্রোতের কারণে এই পুরো এলাকাই কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ফলে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। সন্ধ্যার পরও যানজটে আটকা থেকে বিপুল মানুষকে দুর্ভোগও পোহাতে হয়।
সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশাল এ জনসভায় আরও বক্তব্যে রাখেন উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, নগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ, সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আহমদ হোসেন, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, যুবলীগের হারুনুর রশিদ, শ্রমিক লীগের শুক্কুর মাহমুদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্লা মোঃ আবু কাউছার, কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা, যুব মহিলা লীগের নাজমা আখতার এমপি, ছাত্রলীগের এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ প্রমুখ বক্তব্যে রাখেন। সমাবেশ পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা জড়িত ছিলেন বলেই ঘটনার দিন আত্মগোপনে গিয়েছিলেন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি সিএনএন অনলাইনে একটি রিপোর্টের কথা তুলে ধরে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৫২ দিনের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। ওই বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সামরিক অফিসারসহ প্রায় ৭৩ জন প্রাণ হারান। ওই ৫৭ সামরিক অফিসারের মধ্যে ৩৩ জনই ছিল আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান।
তিনি বলেন, এই বর্বরোচিত ঘটনার সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতারা যে জড়িত ছিল, বিপুল অর্থায়ন করেছে তা সিএনএনের প্রকাশিত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে। উনার নেতারা জড়িত ছিলেন বলেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার কিছু আগেই তিনি (খালেদা জিয়া) ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। এখন বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় খুনীদের পক্ষে যেসব আইনজীবী আইন লড়াই করছেন, তাদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের লোক। আসলে খুনীদের লালন-পালন, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতিই হচ্ছে তাঁর (খালেদা জিয়া) রাজনীতি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল ক্ষমতায় আসলে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। আমরা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছি, অনেকগুলোর রায়ও ইতোমধ্যে পেয়েছি। কিন্তু এসব কাজ পছন্দ নয় আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় তিনি হরতালের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারছেন, যানবাহনে আগুন দিচ্ছেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন। উল্টো এই সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, উনি ক্ষমতায় গেলে নাকি সব যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেবেন। স্বাধীন দেশে এর থেকে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?
তিনি বলেন, খুনী, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করাই বিরোধী দলের নেতার চরিত্র। ক্ষমতায় থাকতে তিনি খুনী, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন। ২১ আগস্ট আমাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তারা হত্যার বিচার না করে উল্টো আলামত পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছিল, জজ মিয়ার নাটক সাজিয়েছিল। আজ প্রমাণ হয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তাঁর (খালেদা জিয়া) মন্ত্রিসভার সদস্য ও ছেলে তারেক রহমান জড়িত ছিল।
বিরোধী দলের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রীকে আগেরবার আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলাম। জবাবে উনি ৪ মে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন এই সময়ের মধ্যে তিনি সরকারকে উৎখাত করবেন, আমি নাকি পালানোরও পথ খুঁজে পাব না। কৈ আমি তো এখনও বহাল তৈবিয়তেই আছি। আলোচনায় না এসে উনি জামায়াত ও হেফাজতকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দিলেন, শ’ শ’ কোরান শরীফ পুড়িয়ে দিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা ইসলাম ধর্মের হেফাজতের নামে কোরান শরীফ পুড়িয়ে দেয় তারা কী ভাবে ইসলামকে হেফাজত করতে পারে? আর এদের নেত্রী হচ্ছেন খালেদা জিয়া। তাদের ধোঁকাবাজি ও ভাওতাবাজির রাজনীতি দেশবাসী ভাল করেই বুঝে গেছে।
দুই নেত্রীর মধ্যে ফোনালাপের প্রসঙ্গে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবসময়ই শান্তিতে বিশ্বাস করি। আর এ কারণে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ফোন করে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালাম। তিনি বলেন, আমি জানি উনি (খালেদা জিয়া) সকালে উঠতে পারে না, সে কারণেই দুপুরে রেড টেলিফোনে কয়েকবার ফোন করলাম। কিন্তু উনি ধরলেন না। পরে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির এক নেতা জানালেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী রাত ৯টার আগে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচে আসতে পারবেন না। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে করে বলেন, যিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী, আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আগামীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন- তাঁর একটি ফোন ধরতে দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় লাগে, উনি ক্ষমতায় আসলে দেশের জন্য কী করবেন?
তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার পর ফোন করে আমি তাঁকে হরতাল প্রত্যাখ্যান করে গণভবনে এসে আলোচনা করার আমন্ত্রণ জানালাম। উনি আমার কথা রাখলেন না। হরতাল করে ২০ জন মানুষকে হত্যা করলেন। এই ২০ মানুষের হত্যার দায়-দায়িত্বও তো তাঁকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, দেশের ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন থাকার পরও আমি দেশ ও জাতির স্বার্থে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানালাম আসুন সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচন করি, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। আপনি কোন কোন মন্ত্রিসভা চান, আসুন আলোচনা করে ঠিক করি। শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে ফোনালামে আমাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে। তার পরও আমার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উনি হরতাল করে মানুষের জীবনহানী ঘটালেন? আর কত রক্ত ও মায়ের বুক তিনি খালি করতে চান?
আবারও ৬০ ঘণ্টার হরতাল আহ্বানের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাল (সোমবার) ২১ লাখ ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। উনি হরতাল দিয়ে এত কমলমতি ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার পথ বন্ধ করে দিলেন। নিজে এসএসসি পাস করতে পারেননি, সরকারী কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে দুই ছেলেকে উনি কী শিক্ষা দিয়েছেন? পড়াশুনা নয় উনি ছেলেদের মানুষ হত্যা, গ্রেনেড মারা, হাওয়া ভবন খুলে ব্যবসার কমিশন খাওয়া আর বিদেশে অর্থ পাচার করা শিখিয়েছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি (খালেদা জিয়া) ওয়ান ইলেভেনের কথা ভুলে গেছেন। তাঁর কারণেই তো ১/১১’র সৃষ্টি। উনি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ছাড়াও ৯ জনকে ডিঙ্গিয়ে মঈন উ আহমদকে সেনাপ্রধান এবং জাতিসংঘ থেকে ডেকে এনে ফখরুদ্দিন আহমদকে গবর্নর করেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তাঁর এত প্রিয় লোক থাকতেও তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে, দুই ছেলেকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। সেই একই জিনিস (তত্ত্বাবধায়ক) তিনি চাচ্ছেন কার স্বার্থে? আবারও তত্ত্বাবধায়ক আসলে উনাকে যে জেলে যেতে হবে না তার গ্যারান্ট্রি কোথায়? তিনি বলেন, আর যাতে কেউ অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে সংবিধান সংশোধন করে তা আমরা নিশ্চিত করেছি।
আগামীতে হরতালের নামে কেউ জানমালের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের সকল মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব কমিটির মাধ্যমে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে। যথাসময়েই আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলব। ইনশাল্লাহ দেশের মানুষ আবারও নৌকায় মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের দেশসেবার সুযোগ দেবে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বসভায় উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব।