সাঁথিয়ার ঘটনা জামায়াত শিবিরের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কৌশলের অংশ
বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশজুড়ে নানা কৌশলে উস্কানি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্য কাজ করছে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠী। নির্বাচন আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যতই এগিয়ে যাওয়া হবে উস্কানি দিয়ে ততই চালানো হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। জামায়াত নেতা দোলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচারের পর চালানো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদীদের নকশা অনুযায়ীই চলে নাশকতা। নাশকতার ছকে রেখেছে হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব সংখ্যালঘু পরিবার ও উপাসনাল। কক্সবাজারের রামুর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহতার পর শনিবার একই কায়দায় পরিকল্পিতভাবে ফেসবুকে মহানবীকে কটূক্তির খবর ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকা পাবনার সাঁথিয়ায়। নিজামীর বিচারের কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ার মুখেই যেখানে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরসহ তা-ব চালানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতীদের চেহারা। ঘটনায় ক্ষুব্ধ পুরো দেশ। দোষীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এখন পরিষ্কার- হাটহাজারী, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা রামু, উখিয়া, টেকনাফ পটিয়া আর পাবনার সাঁথিয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। কক্সবাজারের ঘটনায় জামায়াতের ইন্ধন ছিল বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সংঘাত সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। দুটি উদ্দেশ সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করছে বলে মনে করছে পুশিল। এক সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে অরাজকতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা। দুই হামলার প্রতিউত্তরে সংখ্যালঘুরা পাল্টা হামলা চালালে ধর্মের দোহাই দিয়ে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করা। গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে সাম্প্র্রায়িক উস্কানি দিয়েছিল তারা। যার রেস ধরে হামলা হয়েছিল টেকনাফ, উখিয়া ও চট্টগ্রামের পটিয়াতে। পাকিস্তানী আমলের ধর্মীয় উন্মাদনার সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সেই পুরানো কৌশলকে বেছে নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। জামায়াত-শিবিরের কর্মকা- নিয়ে যারা কাজ করেন তারা মনে করছেন, গ্রেনেড, বোমা হামলা, নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকা-, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করাসহ সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির পথ বেছে নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। গত বছর চট্টাগ্রামের হাটহাজারীর নন্দিরহাটে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মন্দির ও মূর্তি ভাংচুর করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তবে ভয়াবহতার কথা কেউ আজে ভুলতে পরছে না গত বছরের রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনা। যেখানে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে বাড়িঘর, বৌদ্ধবিহার ও মন্দির জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হয়। আর শরিক জামায়াতকে রক্ষায় সেদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আইওয়াশ হিসেবে মতো একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বিএনপি। ব্লগার রাজীবের মতো সেবারও হামলার আগে উত্তম বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ছেলের ফেসবুকে ট্যাগ করা হয় ইসলাম ধর্ম অবমাননার ছবি। এই ছবি প্রিন্ট করে দশদিন প্রচারণা চালানো হয় পাড়া-মহল্লায়। এর পর রাতের আঁধারে শুরু হয় মন্দিরে হামলার ধ্বংসযজ্ঞ। ব্লগার রাজীবকে মারার পর তার নামে কয়েকটি সাইট খুলে উস্কানি দেয়া হয় ধর্মের নামে। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে এর কয়েক দিন পর হামলা শুরু করা হয় সংখ্যালঘুদের ওপর।
সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে এবং ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে জামায়াতের হরতালে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছিল। বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রতিমাসহ মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়। দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীগঞ্জ উত্তর মহেশপুর গ্রামে ১২ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষক পরিবারের বাড়ির ও খড়ের গাদায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। দিনাজপুরে চলতি বছরই ‘হিন্দুরা’ মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করেছে- এমন একটি মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বর্বরতা চালানো হয়েছিল সংখ্যালঘুদের ওপর। এখানেই শেষ নয় সাতক্ষীরায় মঞ্চ নাটকে মহানবীকে কটূক্তি করা হয়েছে এমন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বর্বরতা চালানো হয়েছিল। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ফতেপুর ও চাকদাহ গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হামলা, লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। একের পর এক এ ধরনের বর্বরতার ঘটনা নিয়ে জাতি যখন উদ্বিগ্ন ঠিক তখনই রবিবার খোদ জামায়াতের আমিরের এলাকা পাবনায় ঘটলো নাশকতা। রামুর মতোই আবার ফেসবুকে মহানবীকে কটূক্তি করার অভিযোগ তুলে সাঁথিয়া উপজেলায় হিন্দু বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে সোমবার তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া এক সর্বদলীয় বৈঠকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে আতঙ্ক কাটছে না জামায়াত প্রভাবিত এ এলাকায় সংখ্যালঘুদের মাঝে। জানা গেছে, সাঁথিয়ার বনগ্রাম এলাকার দশম শ্রেণীর ছাত্র রাজীব সাহার (১৭) ফেসবুক পাতায় মহানবীকে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজনা দেখা দেয়। রাজীব সাহার বাড়িসহ স্থানীয় হিন্দুদের অন্তত ৩৫টি বাড়ি, তিনটি মন্দির ও ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এতে আতঙ্কিত হিন্দুরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পাবনার আতাইকুলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল বলেন, রাজীবের বাবা বাবলু সাহা বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সি মুনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই মহল্লার কয়েকটি পরিবারের লোকজন ছেলেমেয়ে, মালপত্র নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে দেখা গেছে। অনেকেই চলে যান গোপনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক জন বলেন, একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন (কালীপুজো) যে নারকীয় তা-ব চালানো হয়েছে তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তাদের একজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বাপ-দাদার পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বিষয়টি ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। কিছুই তো আর করার নেই। যার বিরুদ্ধে খবর ছড়ানো হয়েছে এই কিশোরের আদৌ কোন ফেসবুক পেজ আছে কি না, তার সহপাঠীরা জানে না তা। পুলিশ বলছে, গোটা ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে মনে করছে তারা। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার শুনানির শেষ পর্যায়ে তার এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়াতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। অন্যদিকে, ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগ তুলে পাবনায় হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় দোষীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রবিবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। আদেশে, পুলিশের মহা-পরিদর্শক, পাবনার এসপি ও পাবনার সাঁথিয়া থানার ওসিকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা বিধানের জন্য দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় ও ফেসবুকে ওই পোস্টদাতাকে চিহ্নিত করতে বলেছে আদালত। পাবনার সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার তীব্র জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। একই সঙ্গে হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এ ঘটনায় ক্ষোভ উদ্বেগ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে পরিষদ। একই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গীবাদ বিরোধী মঞ্চ বিবৃতিতে জানায় দেশের সম্প্রীতির পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রাসের আবহ সৃষ্টি করে তাদের দেশ ছাড় করতে চায়। নিন্দা জানায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশের আহ্বায়ক সুলতানা কামালও এক বিবৃতিতে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনা সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করার জন্য পৃথক আইন করার দাবি করেন। একই সঙ্গে পূর্বে ঘটে যাওয়া সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবি করে গণসংহতি আন্দোলন। তবে দেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো যখন উগ্রবাদীদের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন রবিবার এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে সরকার এসব ঘটাচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশ বিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তা করছে।
বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশজুড়ে নানা কৌশলে উস্কানি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্য কাজ করছে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠী। নির্বাচন আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যতই এগিয়ে যাওয়া হবে উস্কানি দিয়ে ততই চালানো হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। জামায়াত নেতা দোলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচারের পর চালানো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদীদের নকশা অনুযায়ীই চলে নাশকতা। নাশকতার ছকে রেখেছে হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব সংখ্যালঘু পরিবার ও উপাসনাল। কক্সবাজারের রামুর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহতার পর শনিবার একই কায়দায় পরিকল্পিতভাবে ফেসবুকে মহানবীকে কটূক্তির খবর ছড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকা পাবনার সাঁথিয়ায়। নিজামীর বিচারের কার্যক্রম এগিয়ে যাওয়ার মুখেই যেখানে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরসহ তা-ব চালানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতীদের চেহারা। ঘটনায় ক্ষুব্ধ পুরো দেশ। দোষীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এখন পরিষ্কার- হাটহাজারী, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা রামু, উখিয়া, টেকনাফ পটিয়া আর পাবনার সাঁথিয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। কক্সবাজারের ঘটনায় জামায়াতের ইন্ধন ছিল বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সংঘাত সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। দুটি উদ্দেশ সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করছে বলে মনে করছে পুশিল। এক সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে অরাজকতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা। দুই হামলার প্রতিউত্তরে সংখ্যালঘুরা পাল্টা হামলা চালালে ধর্মের দোহাই দিয়ে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করা। গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে সাম্প্র্রায়িক উস্কানি দিয়েছিল তারা। যার রেস ধরে হামলা হয়েছিল টেকনাফ, উখিয়া ও চট্টগ্রামের পটিয়াতে। পাকিস্তানী আমলের ধর্মীয় উন্মাদনার সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সেই পুরানো কৌশলকে বেছে নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। জামায়াত-শিবিরের কর্মকা- নিয়ে যারা কাজ করেন তারা মনে করছেন, গ্রেনেড, বোমা হামলা, নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকা-, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করাসহ সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির পথ বেছে নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা। গত বছর চট্টাগ্রামের হাটহাজারীর নন্দিরহাটে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মন্দির ও মূর্তি ভাংচুর করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তবে ভয়াবহতার কথা কেউ আজে ভুলতে পরছে না গত বছরের রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনা। যেখানে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে বাড়িঘর, বৌদ্ধবিহার ও মন্দির জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হয়। আর শরিক জামায়াতকে রক্ষায় সেদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আইওয়াশ হিসেবে মতো একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বিএনপি। ব্লগার রাজীবের মতো সেবারও হামলার আগে উত্তম বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ছেলের ফেসবুকে ট্যাগ করা হয় ইসলাম ধর্ম অবমাননার ছবি। এই ছবি প্রিন্ট করে দশদিন প্রচারণা চালানো হয় পাড়া-মহল্লায়। এর পর রাতের আঁধারে শুরু হয় মন্দিরে হামলার ধ্বংসযজ্ঞ। ব্লগার রাজীবকে মারার পর তার নামে কয়েকটি সাইট খুলে উস্কানি দেয়া হয় ধর্মের নামে। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে এর কয়েক দিন পর হামলা শুরু করা হয় সংখ্যালঘুদের ওপর।
সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে এবং ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে জামায়াতের হরতালে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছিল। বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রতিমাসহ মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়। দিনাজপুর সদর উপজেলার রানীগঞ্জ উত্তর মহেশপুর গ্রামে ১২ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষক পরিবারের বাড়ির ও খড়ের গাদায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। দিনাজপুরে চলতি বছরই ‘হিন্দুরা’ মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করেছে- এমন একটি মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বর্বরতা চালানো হয়েছিল সংখ্যালঘুদের ওপর। এখানেই শেষ নয় সাতক্ষীরায় মঞ্চ নাটকে মহানবীকে কটূক্তি করা হয়েছে এমন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বর্বরতা চালানো হয়েছিল। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ফতেপুর ও চাকদাহ গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হামলা, লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। একের পর এক এ ধরনের বর্বরতার ঘটনা নিয়ে জাতি যখন উদ্বিগ্ন ঠিক তখনই রবিবার খোদ জামায়াতের আমিরের এলাকা পাবনায় ঘটলো নাশকতা। রামুর মতোই আবার ফেসবুকে মহানবীকে কটূক্তি করার অভিযোগ তুলে সাঁথিয়া উপজেলায় হিন্দু বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে সোমবার তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া এক সর্বদলীয় বৈঠকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে আতঙ্ক কাটছে না জামায়াত প্রভাবিত এ এলাকায় সংখ্যালঘুদের মাঝে। জানা গেছে, সাঁথিয়ার বনগ্রাম এলাকার দশম শ্রেণীর ছাত্র রাজীব সাহার (১৭) ফেসবুক পাতায় মহানবীকে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজনা দেখা দেয়। রাজীব সাহার বাড়িসহ স্থানীয় হিন্দুদের অন্তত ৩৫টি বাড়ি, তিনটি মন্দির ও ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এতে আতঙ্কিত হিন্দুরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পাবনার আতাইকুলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল বলেন, রাজীবের বাবা বাবলু সাহা বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সি মুনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই মহল্লার কয়েকটি পরিবারের লোকজন ছেলেমেয়ে, মালপত্র নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে দেখা গেছে। অনেকেই চলে যান গোপনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক জন বলেন, একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন (কালীপুজো) যে নারকীয় তা-ব চালানো হয়েছে তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। তাদের একজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বাপ-দাদার পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বিষয়টি ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। কিছুই তো আর করার নেই। যার বিরুদ্ধে খবর ছড়ানো হয়েছে এই কিশোরের আদৌ কোন ফেসবুক পেজ আছে কি না, তার সহপাঠীরা জানে না তা। পুলিশ বলছে, গোটা ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে মনে করছে তারা। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার শুনানির শেষ পর্যায়ে তার এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়াতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। অন্যদিকে, ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগ তুলে পাবনায় হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় দোষীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রবিবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। আদেশে, পুলিশের মহা-পরিদর্শক, পাবনার এসপি ও পাবনার সাঁথিয়া থানার ওসিকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা বিধানের জন্য দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় ও ফেসবুকে ওই পোস্টদাতাকে চিহ্নিত করতে বলেছে আদালত। পাবনার সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার তীব্র জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। একই সঙ্গে হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এ ঘটনায় ক্ষোভ উদ্বেগ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে পরিষদ। একই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গীবাদ বিরোধী মঞ্চ বিবৃতিতে জানায় দেশের সম্প্রীতির পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রাসের আবহ সৃষ্টি করে তাদের দেশ ছাড় করতে চায়। নিন্দা জানায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশের আহ্বায়ক সুলতানা কামালও এক বিবৃতিতে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনা সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করার জন্য পৃথক আইন করার দাবি করেন। একই সঙ্গে পূর্বে ঘটে যাওয়া সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবি করে গণসংহতি আন্দোলন। তবে দেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো যখন উগ্রবাদীদের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন রবিবার এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে সরকার এসব ঘটাচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশ বিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তা করছে।